নমস্কার

প্রথমেই বলি ডুয়ার্স অনেকের মতন আমার ও আবেগের জায়গা। তাই কিছু মানুষের উদ্দেশ্য প্রণোদিত মন্তব্যে বা কর্তব্যে এই লেখা টা লিখতে বাধ্য হচ্ছি।

আমি ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন রিসর্ট নিয়ে মার্কেটিং করি। নিজের ও আছে একটি। কিন্তু এর বাইরে ও আমি সামান্য একজন লেখক। বিভিন্ন রহস্য ও ভৌতিক গ্রুপে আমি নিয়মিত লিখি।
প্রথমেই বলি ডুয়ার্স দীঘা বা পুরী বা শান্তিনিকেতন না। এখানে অফ সিজনে 400-500 টাকাতে রুম পাওয়া যায় না। আর সিজনে তা ডাবল হয়ে যায় না।
এখানে স্ট্যান্ডার্ড ডাবল বেড (নন এসি) =800 টাকার নিচে হয় না। আর হলেও সিজনে 1500 হয়ে যায় না। পুরী, দীঘার মতন প্রতিনিয়ত এখানে গেস্ট আসেও না।
তাই দীঘা বা পুরীর মতন ডুয়ার্সের ব্যবসা 12 মাস ই লাভজনক না।
এখানে যারা রিসর্ট করেছেন, বেশীর ভাগই শুধু লাভ নয়, আবেগের উপর আর প্রকৃতির প্রেমে পড়ে ও রিসর্ট করেছেন। তাই লেবার পেমেন্ট বা মেইনটেনেন্স চার্জ তুলতে গেলে খরচ কমানোর উপায় নেই। সমুদ্রের পাড়ের মতন এখানে সস্তাতে মাছ পাওয়া যায় না। তাই খাবার ও সস্তাতে সম্ভব না। 400 থেকে 550 টাকা এক এক জায়গাতে। এখানে 300 টাকাতে সারাদিনের খাওয়া সম্ভব না।
এবারে অনভিপ্রেত প্রসঙ্গের দিকে যাচ্ছি।

কিছু জ্ঞান পাপী (সবাই না কিন্তু) হঠাৎ হঠাৎ প্রায় 10-15 টা গ্রুপে লিখে দেয়, —“আমি অমুক সময়ে ডুয়ার্স যাচ্ছি। আমাকে টর্চ মেরে আলো দেখান। কিভাবে যাব? কি রকম থাকব? কি খাব? কি ভাবে চড়ব (গাড়ি)? কি দেখব? —দয়া করে প্ল্যান টা বলে দিন না। অগ্রিম ধন্যবাদ “–
ব্যাস, তারপর কি মজা দেখুন। পুকুরে জাল না ফেলার আগে যেমন বোঝা যায় না, কত মাছ রয়েছে।

তেমনি –গ্রুপে কত রিসর্ট মালিক আর এজেন্ট আছে, সেটাও বোঝা যায় না এ ধরনের প্রশ্ন না এলে।
মজা টা এরপর শুরু হয়।

জলদাপাড়া থেকে মিঃ দাস, মিঃ ব্যানার্জি, মিসেস রায়রা ( নাম গুলো কাল্পনিক) বলবেন আমার রিসর্টে আসুন। সব ব্যবস্থা করে দেব। এখান থেকে ই পুরো ঘুরে নিন।
আবার লাটাগুরি থেকে জনা দশেক মালিক জ্ঞান দেওয়া শুরু করবেন। লাটাগুরি থেকে পুরো টা ঘুরে নিন।

এর মধ্যে মূর্তি বা সেন্ট্রাল ডুয়ার্স থেকে ও কেউ কেউ ফোন করবেন পার্টি কে কব্জা করার জন্য।
তার মধ্যে বেশ কিছু ছোট, বড় এজেন্ট ও আছে । এমন কি ডুয়ার্স কোন দিন আসে নি, এমন দুধের শিশু এজেন্ট ও আছে। তারা ও সব পরামর্শ দিল, সবচেয়ে কম খরচে নাকি পুরো ডুয়ার্স ঘুরিয়ে দেবে ।
এবার একবার সেই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাটির ( যদি সে যথার্থ ই না জেনে গ্রুপে পোস্ট করে) কথা ভাবুন। সে কার টা গ্রহণ করবে?
কিংবা সেই জ্ঞান পাপি লোক টার কথা ভাবুন। যে তীর টা ছুড়েই রগর দেখছে কটা মাছ ( রিসর্ট মালিক বা এজেন্ট) ঘায়েল হল।

ভাবার বিষয় হল। সত্যি কারের যারা ট্রাভেলার, যারা সারা বছর ডুয়ার্স চষে বেড়ায়। তাদের অভিজ্ঞতার কথা চাপা পড়ে যায় মুষ্টিমেয় কিছু রিসর্ট মালিক বা ট্রাভেল এজেন্টের জন্য। যারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া গেস্ট দের কোন স্বার্থ সাধারণত দেখেন না। সবার কথা বলব না। ভাল ভাল ট্রাভেল এজেন্টরা বা রিসর্ট মালিক রা এই ইঁদুর প্রতিযোগিতায় নামেন না। নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে।
যার ফলে ঐ হতভাগ্য গেস্ট টি কোন না কোন ফক্কর বাজের পাল্লাতে পড়তেই পারেন।
আর তারপর ঘুরে এসে বেশিরভাগ সময় খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করবেন। এতে ক্ষতি হবে ডুয়ার্স পর্যটনের।

আসলে আমি কোন ট্রাভেল এজেন্সি বা রিসর্ট মালিক কে খারাপ বলছি না। আমি নিজেও একটি রিসর্টের সঙ্গে যুক্ত আর এজেন্ট। কিন্তু কোথায়ও যেন কারোর সঠিক চাহিদার সঙ্গে যোগান সঠিক মাপ কাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারছে না।

কিছু উপদেশ–
শুধু দু একটা ভ্রমণের বই পরে ডুয়ার্স আসবেন না। রাম বাবু, শ্যাম বাবুর ডুয়ার্স ঘুরে আসার অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেও আপনি প্ল্যান করবেন না।
কারণ রাম বাবু বা শ্যাম বাবু কি রকম লাইফ স্টাইল পছন্দ করেন। কি রকম জার্নি করেছেন। ওনাদের খাবার বা বেড়ানোর মান কেমন ছিল, তা আপনি জানেন না।
তাই তার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে কোন ভাল ট্যুর গাইড বা ট্রাভেলার বা নাম করা ট্রাভেল এজেন্টের স্মরণাপন্ন হন।

আর একটা কথা—

ডুয়ার্স কিন্তু জলপাইগুরি, কালিম্পং, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জেলার বেশ কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। তাই শুধু মাত্র লাটাগুরি, মূর্তি, জলদাপাড়া, জয়ন্তি থাকলেই ডুয়ার্স ঘোরা হয় না।

আপনার লাটাগুরিতে রিসর্ট আছে বলেই গেস্ট কে শুধু লাটাগুরি নিয়ে লাট খাওয়াবেন না। কিংবা মূর্তির সামনে আপনার রিসর্ট বলে সবাই কে মূর্তি বলে বলে আসন্ন স্ফূর্তি তে মশগুল হয়ে বেশী গুল মারবেন না।

বাতাবারি, মঙ্গলাবাড়ি, ধুপঝোড়া, ধুপগুরি, চালসা, গৌরিগাঁও, ফাগু, মাল বাজার, কোদাল বস্তি, গয়েরকাটা এই সব জায়গাতেও প্রচুর রিসর্ট আছে। আপনারা গেস্ট কে জানাতে পারেন না। বা জানাতে দেওয়া হয় না।

কারণ বেশীর ভাগ ট্রাভেল এজেন্সি গেস্ট কে লাটাগুরি বা জলদাপাড়া পাঠান দায়সারা ভাবে। কারণ সব বই পড়া গেস্ট।

গেস্টরা জানেনা তারা দু রকম ভাবে বোকা বনছে।
এক — সাফারির টিকিট এখন লাইনে দাঁড়িয়ে না কাটলেও চলে। জিপসি ড্রাইভার রাই সরাসরি রিসর্ট টু রিসর্ট ঘুরিয়ে আনে।

দুই–
লাটাগুরি এখন আর আগের লাটাগুরি নেই। বড়বাজারের মতন ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। বাগান বাড়ি তো শহরের বুকেও আছে। তার জন্য ঘিঞ্জি পরিবেশে রিসর্টের কৃত্রিমতা গ্রহণ কেন করবেন? থাকার জন্য একটু অফবিট চুজ করুন। যেখানে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারবেন। চালসার কাছে গৌরিগাঁও, গোরুবাথানের কাছে ফাগু, লাল ঝামেলা র কাছে কিছু হোম স্টে…… সন্ধান করুন পেয়ে যাবেন।

তিন-
পশ্চিম ডুয়ার্সে থাকলে চালসা কে সেন্টার করে ঝান্ডি, লামাগাঁও, লাভা, রিশপ, কোলাখাম, লাটপাঞ্চার, সিটং, মহানন্দা , 7 পয়েন্ট্স এসব ঘুরতে পারবেন।
আবার লাটাগুরি বা মূর্তি থাকলেও ডুয়ার্সের অন্য প্রান্তে যেতে আপনাকে চালসা হয়ে ই যেতে হবে। তাই আপনার আদর্শ থাকার প্ল্যান হওয়া উচিত এইরকম—

লাভা= (1-2) রাত
কভারিং এরিয়া লাভা, কোলাখাম, ন্যাওড়া ফরেস্ট, রিশপ, লোলেগাঁও, ঝান্ডি, লামাগাঁও, ফাগু, চেল খোলা, ডালিম ফোর্ট,

চালসা (লাটাগুরি বাদ)=(2-3 রাত।
কভারিং এরিয়া — গৌরিগাঁও, ঝালং, বিন্দু, মূর্তি, প্যারেন, সামসিং, সুন্তালেখোলা, রকি আইল্যান্ড, লালিগুরাস, গোরুমারা, চাপরামারি, মেদলা ওয়াচটাওয়ার, লাল ঝামেলা, গাজোলডোবা, বোদাগঞ্জ 51 পিঠ মন্দির, বেঙ্গল সাফারি পার্ক, জল্পেশ ইত্যাদি

গয়েরকাটা=(1-2)রাত
কভারিং এরিয়া — চামর্চি, খুট্টিমারী, নাথুয়া, গারুচিরা ফরেস্ট

জলদাপাড়া=(1-2) রাত
কভারিং এরিয়া –
টোটোপাড়া, সাউথ খয়েরবাড়ি, ফুন্টসোলিং,

চিলাপাতা =(1-2) রাত
কভারিং এরিয়া — কোদাল বস্তি, মেন্দাবাড়ি, নল রাজার গড়। রাজাভাতখাওয়া, সিকিয়াঝোড়া।

জয়ন্তি =(1-2) রাত
বক্সা ফরেস্ট, ফোর্ট, লেপচাখা, রায় মাটাং, জযন্তি, পোখরী লেক, চুনিয়া ও ভুটিয়া ওয়াচটাওয়ার, মহাকাল ইত্যাদি।

কোচবিহার–1 রাত।
কভারিং এরিয়া– পাতালখাওয়া, রসিকবিল, রাজ প্রাসাদ, বাণেশ্বর শিব মন্দির, মদন মোহন মন্দির ইত্যাদি।

এছাড়া আরও কিছু জায়গা আছে। মনে পড়ল না সব।

সব শেষে আর একটা কথা গরম ডুয়ার্সে সাংঘাতিক পড়ে না। সর্বোচ্চ 31 ডিগ্রি। যারা বাতানুকূল পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত। তাদের অনুরোধ—

ডুয়ার্সে গরমে এসে নিজের সমস্যার জন্য অন্যকে ভুল তথ্য দেবেন না।

ডুয়ার্সে গরম বেশী পড়লে বৃষ্টি নেমে একটু তাপমাত্রা কমে। জঙ্গলের ভিতরে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ 26 ডিগ্রি। তাই গরম নিয়ে অপবাদ দেবেন না।

বর্ষাকালে ডুয়ার্স সবচেয়ে সুন্দর। প্রকৃতি পুরো সেজে ওঠে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার পলাশ ফুলের মতন ডুয়ার্স বর্ষাতে সবুজ হয়ে যায়। নদী গুলো ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়। তাই বর্ষাতে ও আসতে পারেন।

আর যারা টিনের চাল দেখে নাক সিটকোন। তাদের বলি ডুয়ার্সের বেশীর ভাগ রিসর্ট ই টিনের চালের।

আর পোকা? জঙ্গলের কাছে এলে ওরা আপনাকে অভ্যর্থনা করবেই। ভয় পেলে আসবেন না। সৌন্দর্য টাই মিস করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *